• বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০৯ অপরাহ্ন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি বিনিয়োগ প্রাপ্তির ব্যর্থতা পর্যালোচনা

অনলাইন  ডেস্ক ।। বাংলাপত্রিকা / ৫৯ পাঠক
আপডেট সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
ছবি : সংগৃহীত

অনলাইন ডেস্ক ।। বাংলাপত্রিকা . কম

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে ধনী অথবা দরিদ্র হওয়াটা নির্ভর করে সে দেশের সম্পদ এবং উৎপাদনের ওপর। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। শিল্প খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হলে কর্মসংস্থান, রপ্তানি, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্রতা হ্রাস পায় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে দেশীয় উদ্যোক্তাদের এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের বিরাট ভূমিকা ছিল।

মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যেকোনো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ আসাটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা তেমনভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না অথবা বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ আমরা তেমনভাবে বৃদ্ধি করতে পারছি না।

২০২৩ সালে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রাপ্ত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৬৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ৭০.৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ৩৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ২১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রাপ্ত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনেক সময় বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার ফলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে অন্য দেশে বিনিয়োগের চেষ্টা করেন।

দেশের স্বার্থেই এই দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে সম্পত্তির টাইটেল পরিবর্তন করতে গড়ে ২৭১ দিন লেগে যায়, অনেক দেশে একই কাজের জন্য গড়ে প্রয়োজন হয় মাত্র ৪৭ দিন। বাংলাদেশে কোর্টের মাধ্যমে বাণিজ্যিক বিতর্কের মীমাংসা হতে গড়ে প্রায় এক হাজার ৪৪২ দিন লেগে যায়, যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে গড়ে ৫৭০ দিন প্রয়োজন হয়। কোনো নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অথবা কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে প্রয়োজন হয় ১৫০ দিন। মালয়েশিয়ায় ২৪ দিন, সিঙ্গাপুরে ৩০ দিন এবং ভিয়েতনামে ৩১ দিন প্রয়োজন হয়।

বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স সংগ্রহ করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয় বলে অভিযোগ করেন। বিভিন্ন জটিলতা এবং অনুন্নত অবকাঠামোর কারণে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেশি বলে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, যদিও এরই মধ্যে বিনিয়োগসংক্রান্ত আইন, কর সুবিধা, স্পেশাল ইকোনমিক জোনের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; তবু বৈদেশিক বিনিয়োগ আশানুযায়ী বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াও অনুন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, দুর্নীতি, শ্রমিকদের অপেক্ষাকৃত কম কর্মক্ষমতা, ব্যাবসায়িক সুশাসনের অভাব, অনুন্নত অর্থবাজার, পুঁজি ও মুদ্রা বাজার, জটিল করকাঠামো, কাঁচামাল, মেশিন ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কের বারবার পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারছে না।

নতুন নতুন শিল্প-কারখানা তৈরির সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র সংকট পরিলক্ষিত হয়। কর্মক্ষম, দক্ষ এবং উপযুক্ত জনবলের অভাবও আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানগুলো উপযুক্ত জনবল না পাওয়ার ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে দক্ষ জনবল আনতে বাধ্য হয় এবং অন্যদিকে উপযুক্ত যোগ্যতা না থাকার ফলে চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি পায় না। উপযুক্ত চাকরির ক্ষেত্রের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জাপান অথবা দক্ষিণ কোরিয়া যদি ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক খাতে অথবা অটোমোবাইল সেক্টরে বিনিয়োগ করতে চায়, তবে প্রচুর পরিমাণ ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন হবে এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অথবা টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল এডুকেশন সেন্টারের প্রয়োজন হবে।

আমাদের দেশে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, টেলিযোগাযোগ সেক্টর, পোলট্রি, ইনফরমেশন টেকনোলজি সেক্টরে বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিক কর্মরত। বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য খাত হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গার্মেন্টস সেক্টর, ওষুধশিল্প, টেক্সটাইল সেক্টর, ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক শিল্প, অটোমোবাইল সেক্টর ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলোর কার্যকর পদক্ষেপগুলোর ওপর দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করছে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে এমন দুটি সূচক ইডিবি (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) এবং জিসিআইয়ে (গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স) বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।

অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চলে দ্রুত সেবা প্রদানের জন্য ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ চালু করার পরও কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে না। বাংলাদেশের পোর্টগুলোতে কার্গো ও কনটেইনার সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা এবং লজিস্টিক সহায়তা উন্নত নয়। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়গুলো মূল্যায়ন করে থাকেন। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তাদের বিনিয়োগবান্ধব আচরণ অথবা বিনিয়োগে সহায়ক আচরণ পরিলক্ষিত হয় না।

আমাদের দেশের আইনি কাঠামোর আরো উন্নয়ন প্রয়োজন। এ সমস্যাগুলার কারণে সম্ভাব্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের মনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনাহীন সিদ্ধান্তের ফলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব করা একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাতগুলোকে ফোকাস করে কার্যকর পরিকল্পনা, পলিসি এবং আইন তৈরি করেছে। আমাদের দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা যেন প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও সেবা পেয়ে থাকেন এ জন্য কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার (সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি) প্রয়োজন।

ধারাবাহিক এবং অনুমানযোগ্য বিনিয়োগবান্ধব করকাঠামো গঠন করা সম্ভব হলে দেশে করের মাধ্যমে রাজস্ব ও বৈদেশিক বিনিয়োগ উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যকর নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দেশে প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে ইকোনমিক জোন করা যেতে পারে। জটিল কাস্টমস প্রক্রিয়ার কারণে কাঁচামাল আনায় এবং ছাড়পত্র সংগ্রহে বেশি সময় লেগে যায়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা ভোগান্তির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এসংক্রান্ত ভোগান্তি হ্রাস করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। নৈতিকতা, সুশাসন এবং কার্যকর পদক্ষেপ দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সহায়তা করে।

দেশে সম্ভাব্য বৈদেশিক বিনিয়োগের খাতগুলো যথাযথভাবে শনাক্ত করার পর আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন এবং যেসব বৈদেশিক বিনিয়োগকারী এরই মধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের যথাযথ যত্ন নেওয়া একান্ত প্রয়োজন এবং সর্বদা বিনিয়োগকারীদের নৈতিকভাবে সন্তুষ্ট রাখা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরীয় দূতাবাসের বাণিজ্যিক সেকশনের ডিরেক্টর জেনারেল সামসো কিম প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যকে শুল্কমুক্ত করার পরামর্শ দেন।

বিমানবন্দর অথবা সমুদ্রবন্দরে বাণিজ্যসংক্রান্ত সমস্যার দ্রুত সমাধানে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের সহায়তার জন্য ‘র‌্যাপিড অ্যাকশন সেল’ গঠন করার পরামর্শ দেন। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন দ্রব্যের স্থানান্তরপ্রক্রিয়া আরো কার্যকর করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। বিভিন্ন ডকুমেন্ট, লাইসেন্স, ফি ইত্যাদি প্রক্রিয়ার জন্য বেপজার ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস পয়েন্ট’ পদ্ধতি চালু করা উচিত বলে তিনি মত দেন। এ ছাড়া ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগপ্রক্রিয়া দ্রুত করা প্রয়োজন। ইপিজেডগুলোতে গুদামজাতকরণের প্রক্রিয়াগুলো আরো শক্তিশালী হওয়া দরকার।

এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের জনগণকে বেশি পরিমাণ বাংলাদেশি পণ্য ক্রয় ও ব্যবহারের পরামর্শ দেন। দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য খাতগুলো হচ্ছে—জাহাজ নির্মাণ শিল্প, সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণ, অটোমোবাইল সেক্টর, রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন ইত্যাদি। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ যেসব কারণে এবং যে পদক্ষেপগুলোর কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে, সেগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত কম বৈদেশিক বিনিয়োগ পাওয়ার কারণগুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ একান্তভাবেই প্রয়োজন। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা ও বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রাপ্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে শিল্প-কারখানা বৃদ্ধি করা একটি অপরিহার্য বিষয়।

লিয়াকত লিখন/বার্তা বিভাগ

 


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরোও